২০২০ বছরজুড়ে আবহাওয়ার খ্যাপাটে আচরনের কারন
এ বছর রোদ, বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঝড়, বাতাস—সবকিছুরই তীব্রতা বেশি। এ মাসেও বৃষ্টি বেশি হবে। ঘূর্ণিঝড়েরও আশঙ্কা।
বিদায় নিতে নিতেও থেকে যাচ্ছে মৌসুমি বায়ু। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। ফলে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশ ছাড়তে চলতি অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যাবে।
শুধু তা–ই নয়, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ হতে পারে দুই থেকে তিনটি। মাসের শেষ দিকে একটি ঘূর্ণিঝড়ও আসতে পারে। লঘুচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কিছুদিন পরপর বৃষ্টিপাত হবে।
বছরের এ সময়টায় দেশে সাধারণত খুব বেশি বৃষ্টিপাত হয় না। মৌসুমি বায়ু বিদায় নেয়। এবার থেকে যাওয়াকে
যেমন দেশে এ বছর ১৯৮৮ সালের পর বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। যদিও বাংলাদেশে আঘাত হানার সময় তা শক্তি হারিয়ে ফেলে। রংপুরে ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হলো গত সপ্তাহেই। দেশে গত মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হয়েছে ৩৩ শতাংশ বেশি।
চলতি মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বছরের পুরো সময়েই রোদ, বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঝড় ও বাতাসের শক্তি বা তীব্রতা বেশি দেখা গেছে। গ্রীষ্মের শুরু থেকে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি ছিল। বর্তমান তাপমাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে ১ ডিগ্রি বেশি। তিনি বলেন, তাপমাত্রা বেশি থাকায় সাগরে দ্রুত বাষ্পীভবন ও লঘুচাপ তৈরি হয়। এতে দেশে বৃষ্টি বেশি হয় এবং ঝড় বেশি তীব্রতার সঙ্গে আঘাত হানে।
ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা যে বেশি ছিল, সেটা ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরও বলছে।
বন্যা পিছু ছাড়ছে না

অক্টোবরে এসে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় বন্যাও পিছু ছাড়ছে না। এমনিতেই গত জুলাইয়ের শেষ থেকে দেশের বিস্তৃত এলাকা বন্যার কবলে পড়ে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আরেক দফা বন্যা শুরু হয়েছে।
প্রথম দফায় আমনের বীজতলা নষ্ট হওয়ার পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে কৃষকেরা আরেক দফা বীজতলা তৈরি করেন। কিন্তু আবার তা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ২৭ জুলাই কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রথম বিপৎসীমা অতিক্রম করে। ওই পানি নামতে লেগেছে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত। পূর্বাভাসে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে দুই থেকে তিন দিনের একটি বন্যার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সাত দিন ধরেই বন্যার পানি উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে, এখন যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ছোট যমুনা, ঘাঘট, পদ্মা, ধলেশ্বরী, যমুনা ও আত্রাইয়ের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম থেকে বগুড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যার পানি যমুনা ও পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে। আর পথে পদ্মা ও যমুনার দুই পাড়ে তীব্র ভাঙনের সৃষ্টি করছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা বারবার আঘাত হানার কারণ বঙ্গোপসাগরের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা ও বেশি লঘুচাপ।
বাতাসেও ভিন্ন রূপ

আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন, সাধারণত বছরে আবহাওয়ার যেকোনো এক থেকে দুটি বৈশিষ্ট্যে চরম আচরণ দেখা যায়। কোনো বছর বৃষ্টি বেশি হয়। কোনো বছর শীত তীব্র হয়। কিন্তু এ বছর মার্চ থেকে আবহাওয়ার সব কটি আচরণের মধ্যে তীব্রতা দেখা যায়। বছরজুড়ে গড়পড়তা প্রতি মাসেই স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এতে আগস্টে তিস্তা অববাহিকায় গত ১০০ বছরের মধ্যে পানির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সাধারণত আগস্টে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি লঘুচাপ হয়। কিন্তু এ বছর হয়েছে পাঁচটি। ফলে ওই মাসে বৃষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। সেপ্টেম্বরেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণেই বাড়তি বৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে দুটি করে লঘুচাপ হয়, এ বছর একটিও হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবহাওয়ার আচরণের নিরিখে এই বছরটা বেশ অস্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। কিন্তু বাতাসের প্রবাহের ধরনেও এবার আমরা কিছুটা ভিন্নতা দেখলাম। ফলে এবার ঝড়-বৃষ্টি-বন্যা সবই ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।’
মাশুল মানুষের
দাম বাড়ল সবজির

আগামী কয়েক দিন নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে সারা দেশে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। আগামী দুই–তিন দিন এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে।
এ বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষ কাজ হারিয়েছে। আয় কমেছে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আসে। তারপর বন্যা।
আবহাওয়ার রুদ্ররূপের মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকে। দুর্গত মানুষ কষ্টে আছে। নদীভাঙনে দিশেহারা নদী–তীরবর্তী মানুষ। ফসলের ক্ষতি হয়েছে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় আমন আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। শহরের মানুষকে বাজারে গিয়ে চাল-সবজি কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ তো রয়েছেই।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবহাওয়া প্রত্যেক বছর একই রকম আচরণ করবে, এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। পরিবেশগত কারণেই এর রকমফের ঘটে। তবে দেখতে হবে, আবহাওয়ার পরিবর্তন বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য আমাদের কোনো ভূমি আছে কি না।’ তিনি বলেন, নদী ভাঙছে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বছরখানেক আগেই বলে দিয়েছিল কোথায় কোথায় ভাঙন তীব্র হবে। সেটা আমলে নিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো।
নদী অববাহিকার সব দেশের সঙ্গে নদীসংক্রান্ত সব তথ্যের অবাধ বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকলে বন্যা ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকরী হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ভিডিও